Monday, February 19, 2018

// // Leave a Comment

পথ নির্দেশ : ইমাম মাহদী (আ:)-এর আত্মপ্রকাশ

কিয়ামতের বৃহৎ আলামতসমূহের প্রথম নির্দশন হল হযরত ইমাম মাহদী (আ:)-এর আত্মপ্রকাশ। হাদীসসমূহে বিস্তারিতভাবে ইমাম মাহদী (আ:)-এর আলোচনা স্থান লাভ করেছে। হযরত ইমাম মাহদী (আ:) নবী তনয়া বিবি ফাতিমা (রা:)-এর অধস্তন পুরুষ হবেন। নাম হবে মুহাম্মাদ, পিতার নাম হবে আব্দুল্লাহ।
রাসূল (স:)-এর সাথে আকৃতিগত যথেষ্ট মিল থাকবে। ললাট দেশ প্রশস্ত, নাক সুউচ্চ হবে। ভূপৃষ্ঠ ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতায় ভরে দিবেন। প্রথমত: তাঁর হুকুমাত আরবে প্রতিষ্ঠিত হবে। অতঃপর সারা পৃথিবী বিস্তৃত হবে। সাত বছর পর্যন্ত তাঁর হুকুমাত চলতে থাকবে। হাদীস শরীফ এসেছে :
(ক) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন : ইমাম মাহদী আমার বংশে জন্মলাভ করবে। পেশানী উন্মুক্ত, নাক দীর্ঘ। ভূপৃষ্ঠ ইনসাফ ও ন্যায়বিচারে কানায় কানায় ভরে দিবেন। যেমন তার পূর্বে অত্যাচার-নিপীড়নে পূর্ণ থাকবে। তিনি সাত বছর সাম্রাজ্য পরিচালনা করবেন। (সুনানু আবু দাউদ : ২/৫৮৮) (খ) হযরত উম্মে সালমা (রা:) বলেন, আমি রাসূল (স:)কে ইরশাদ করতে শুনেছি, ইমাম মাহদী আমার বংশের ফাতিমা (রা:)-এর উত্তর পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সুনানু আবু দাউদ-২/২৩৯) আরবী ভাষায় হেদায়েতপ্রাপ্ত, পথপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে “মাহদী” বলে। আভিধানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক, বিশুদ্ধ ই’তিকাদ লালনকারী, দ্বীনের ইলম অনুযায়ী আমলকারী, দৃঢ় আকীদা বিশ্বাসের সৎ মুসলমানকে “মাহদী” বলা যায়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে : অভিধানে আলমাহদী অর্থ আল্লাহপাক যাকে সত্যের প্রতি পথ প্রদর্শন করেছেন। কখনো শব্দটি “নাম” হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি এটি নাম বলে পরিচিত হয়ে গেছে। এ শব্দ দ্বারাই ঐ ব্যক্তির নাম “ইমাম মাহদী” নামকরণ করা হয়েছে যার সম্পর্কে মহানবী (সা:) সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি আখেরী যামানায় আগমন করবেন। (লিসানুল আরব-১৫/৪১৩) এখানে ইমাম মাহদী বলে এক বিশেষ ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। ইমাম মাহদী মদীনায় জন্মলাভ করবেন। আখেরী যামানায় যখন মুসলমানগণ সকল দিক হতে পরাজিত-বিধ্বস্ত হতে থাকবে, একের পর এক যুদ্ধ দামামা বাজতে থাকবে, সিরিয়াতেও খ্রিস্টানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সর্বত্র কাফির-মুশরিকদের জুলুম-নিপীড়ন বৃদ্ধি পেতে থাকবে এমনকি আরব ভূখন্ডের শান-শওকত ও শৌর্য-বীর্য সম্পন্ন নিয়মিত ইসলামী শাসন ব্যবস্থা থাকবে না, খয়বরের কাছাকাছি পর্যন্ত খ্রিস্টানগণ পৌঁছে যাবে এবং তাদের হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হবে। বাচ্চা-কাচ্ছা স্বল্পসংখ্যক মুসলমান মদীনা মনোয়ারায় আশ্রয় গ্রহণ করবে। সে সময় ইমাম মাহদী মনোয়ারাতেই অবস্থান করবেন। মানুষের অন্তরে এ দাবী জাগ্রত হবে যে, এখন ইমাম মাহদীর অন্বেষণ একান্ত প্রয়োজন। তাঁর হাতে ইমামতের শপথ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। সে কালের সৎলোক, ওলী, আবদাল সকলেই ইমাম মাহদীর অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকবে। এ সুযোগে কিছু ভন্ড, প্রতারক ইমাম মাহদী হওয়ার মিথ্যা দাবীদারের উদ্ভব হবে। জনগণ ইমাম মাহদীকে ইমাম ও হাকিম বানানোর চিন্তায় ও প্রচেষ্টায় রত দেখে ইমাম মাহদী আত্মগোপন অবস্থায় মক্কায় প্রস্থান করবেন। একদা বাইতুল্লাহ শরীফ তওয়াফরত অবস্থায় হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের মাঝখানে কতিপয় বিশেষ ব্যক্তি তাঁকে চিনে ফেলবেন ও তাঁকে ঘিরে ধরে ইমাম ও শাসক মেনে সকলে তাঁর হাতে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবেন। ঐ শপথ অনুষ্ঠানের সময় উপস্থিত সকলে আসমান হতে আগত একটি ধ্বনি শুনবে যে, এ ব্যক্তি ইমাম মাহদী, যিনি আল্লাহ পাকের মনোনীত খলিফা এবং জনগণের শাসক। যখন তাঁর বাইয়াতের বার্তা প্রচারিত হবে তখন মদীনা শরীফে সমবেত সেনাদল মক্কা মুকাররমায় এসে একত্রিত হবে। শাম, ইরাক এবং ইয়ামানের সকল ওলি আল্লাহ, কুতুব, আবদাল তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে বাইয়্যাত হবেন তথা আনুগত্যের ঘোষণা দিবেন। হাদীস শরীফে এসেছে :
(ক) হযরত উম্মে সালমা (রা:) হতে বর্ণিত, মহানবী (সা:) ইরশাদ করেন, তৎকালীন খলিফার ইন্তিকালে জনগণের মাঝে মতানৈক্য পরিদৃশ্য হবে। মদীনার জনৈক বিশেষ ব্যক্তি (ইমাম মাহদী) নিজের পরিচয় গোপন রেখে মক্কায় পাড়ি জমাবেন। মক্কাবাসীরা ইমাম মাহদীকে খলিফা বানানোর জন্য অন্বেষণ করতে গিয়ে তাঁকে বের করে ফেলবেন। যদিও তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে সন্তুষ্টচিত্ত থাকবেন না। তা সত্ত্বেও লোকেরা রুকনে হাজার ও মাকামে ইবরাহীমের মাঝে তার হাতে আনুগত্যের বাইয়্যাত করবেন। ... লোকেরা জানতে ও দেখতে পেরে শামের আবদালগণ, ইরাকের জনগণ দলে দলে তাঁর হাতে উক্ত স্থানে আনুগত্যের শপথ নিবেন। (সুনানু আবু দাউদ-২/২৩৯) (খ) জনৈক ঘোষক আসমান থেকে ঘোষণা দিবেন হে লোক সকল! আল্লাহ তাওয়ালা অত্যাচারী, মুনাফিক ও তৎসম গোষ্ঠীসমূহকে তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন ও মুহাম্মদ (স:)-এর উম্মাতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে তোমাদের অভিভাবক নিযুক্ত করেছেন, তোমরা তার সাথে মিলিত হও। সে ইমাম মাহদী। নাম তার মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ। (শরহে আকীদায়ে সিফারিনিয়্যাহ-২/৮০, ৮১) ইমাম মাহদীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে একটি সেনাদল আসতে থাকবে। মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি একটি জনবসতিহীন স্থানে তারা এসে একটি পাহাড়ের নিচে অবস্থান নিবে। মাত্র দুজন লোক ব্যতীত সকলে উক্ত স্থানে ভূমিধসে খতম হয়ে যাবে। ইমাম মাহদী মক্কা হতে মদীনায় আগমন করবেন। অতঃপর শামের দিকে রওয়ানা করবেন। দামিশ্ক উপনীতি হলে খ্রিস্টানদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হবে যাতে বহুসংখ্যক মুসলমান শহীদ হলেও শেষপর্যন্ত বিজয় মুসলমানদের পদচুম্বন করবে। ইমাম মাহদী দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সম্পন্ন করে কুস্তুনতুনিয়া বিজয়ের অভিলাষে বের হবেন। হাদীস শরীফ এসেছে (ক) হযরত আবু হুরাইরা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেছেন : কিয়ামত কায়েম হবে না, যতক্ষণ না রোমবাসীগণ আ’মাক বা দাবিকে অবতরণ করবে। অনন্তর তৎকালীন ভূপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠতম লোকদের একটি সেনা দল মদীনা হতে তাদের মোকাবেলায় বের হবে। অতঃপর তারা কুস্তুনতুনিয়া বিজয় করবে। হযরত হুযাইফাতুবনুল ইয়ামান (রা:) হতে বর্ণিত হাদীসে হযরত রাসূল (স:) একটি ফিতনার কথা বললেন যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অধিবাসীদের মধ্যে মাথাচাড়া দিবে। তাদের মধ্যেই অতিদ্রুত শুষ্ক প্রান্তর হতে সিফয়ানী দল আগমন করবে অন্য একটি সেনাদল মদীনাতে প্রবেশ করবে।
তিনদিন তিনরাত পর্যন্ত মদীনায় লুটতরাজ চালাবে। অতঃপর মক্কাভিমুখে রওয়ানা করবে। তারা যখন ‘বাইদা’ নামক স্থানে পৌঁছবে আল্লাহপাক ফেরেস্তা জিব্রাইলকে প্রেরণ করে বলবেন হে জিব্রাইল! তুমি যাও আর তাদের কাজ শুরু করে। ফেরেস্তা জিব্রাইল তাদের উপর এমন পদাঘাত করবেন যে, আল্লাহ তার মাধ্যমে তাদেরকে ভ‚মিতে ধসে দিবেন। তাদের মধ্যে মাত্র দু ব্যক্তি ব্যতীত কেউ বাঁচবে না। একজন বাশীর অন্যজন নাযীর। (সুনানু দারুকুতনী বাহাওয়ালায়ে তাযকিরাতিল কুরতুবি-৫০৮) ইমাম মাহদীর ব্যাপারে অনেক বেশী রেওয়ায়তেও বর্ণনা এসেছে। উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ইমাম মাহদীর প্রথম প্রকাশ হবে যৌবনকালে। অতঃপর তিনি অন্যের হাতে নিহত হওয়ার শংকায় গোপনে মক্কায় চলে যাবেন। অতঃপর বিভিন্ন স্থানে থাকার পর মক্কায় ফিরে আসবেন। লোকেরা তাকে হাজরে আসওয়াদের কাছে মাতাফে দেখতে পাবে ও চিনে ফেলবে এবং খেলাফত ইমামতের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করবে। অতঃপর তিনি মদীনাভিমুখে রওয়ানা হবেন, তার সাথে মুমিনদের একটি দল থাকবে। তারপর তারা কুফার পথে ভ্রমণ করবেন। সিফয়ানী বাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে আসবেন। আল্লাহ প্রাচ্যবাসীর মধ্য হতে মাহদীর উজিরকে সিফয়ানীর বিরুদ্ধে পাঠাবেন। সিফয়ানী পরাজিত হয়ে শামের দিকে চলে যাবে। ইমাম মাহদী আবার তাকে ধাওয়া করে বাইতুল মুকাদ্দাসের পাশে হত্যা করবেন। (শরহে আকীদায়ে সিফারিনিয়্যাহ-২/৮১-৮২) কুস্তুনতুনিয়া বিজয়ের পর ইমাম মাহদী শামের দিকে রওয়ানা করবেন। শাম পৌঁছার অল্প কিছু দিন পরেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে। শাম ও ইরাকের মধ্যখান হতে দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করে ঘুরতে ঘুরতে দামেশকের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। আসরের নামাযের প্রস্তুতিতে লোকজন ব্যস্ত থাকবে। এমন সময় অকস্মাত হযরত ঈসা (আ:) দু’জন ফেরেস্তার উপর ভর করে আসমান হতে অবতরণ করত দৃষ্টিগোচর হবেন। ঈসা (আ:) কে দেখে দাজ্জাল পলায়ন করবে। পরিশেষে “বাবে লুদ” নামক স্থানে পৌঁছে ঈসা (আ:) দাজ্জালের জীবনাবসান ঘটাবেন। সে সময় ভ‚পৃষ্ঠে কোন কাফির অবশিষ্ট থাকবে না। বরং সকলেই মুসলমান হয়ে যাবে। ইমাম মাহদীর বয়স ৪৫, ৪৮ বা ৪৯ বছর হওয়ার পর তার ইন্তিকাল হয়ে যাবে। হযরত ঈসা (আ:) তাঁর জানাযার নামাজ পড়াবেন। ইমাম মাহদী বাইতুল মুকাদ্দাসের পাশে ইন্তিকাল করবেন ও সেখানেই তাঁর দাফন সম্পন্ন হবে।
(ক) আবু উমামাতুল বাহিলী কর্র্তৃক বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে দাজ্জালের আলোচনা বিদ্যমান। সে হাদীসে একপর্যায়ে উম্মে শারীক বিনতে উবাই বলেন : ঈয়া রাসূলুল্লাহ! সে সময় আরবগণ কোথায় থাকবে? তিনি উত্তরে বললেন, আরবগণ তখন সংখ্যায় খুব স্বল্প হবে। তাদের আশ্রয় হবে বাইতুল মুকাদ্দাস। তাদের ইমাম (খলিফা) হবেন একজন সৎ লোক। একদা তাদের ইমাম (মাহদী নামাজ পড়ানোর জন্য অগ্রসর হবেন। এমন সময় ঈসা ইবনে মারইয়াম তাদের মাঝে অবতরণ করবেন। ইমাম কয়েক কদম পিছে হটে আসবেন। ঈসা (আ:) তার কাঁধে হাত রেখে বলবেন : আপনি আগে বেড়ে নামাজ পড়ান। কেননা এ পদ এখন আপনার জন্যই। ইকামাত হবে। তাদের ইমাম নামাজ পড়াবেন। নামাজ শেষ হলে ঈসা (আ:) বলবেন : তোমরা দরজা খোল। দরজা খোলা হবে। তার পিছনেই দেখা যাবে দাজ্জাল। দাজ্জাল প্রাণপণে পালানোর চেষ্টা করবে। ঈসা (আ:) বলবেন : তোমার উপর আমার একটি আঘাত নির্ধারিত হয়ে আছে। তুমি আমার ঐ আঘাত থেকে বাঁচবে ন। অনন্তর তিনি “বাবুল লুদ” এ তাকে ধরে হত্যা করে দিবেন। আল্লাহ তা’য়ালা ইয়াহুদিদের পরাজিত-পর্যুদস্ত করে দিবেন। (সুনানু আবু দাউদ-২/১৩৫) অতঃপর হযরত ঈসা বিন মারইয়াম (আ:)-এর হাতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত হবে। ইমাম মাহদী ঈসা (আ:)কে নিয়ে নামাজ পড়াবেন। অতঃপর ঈসা (আ:)-এর পিছনে ইমাম মাহদী নামাজ পড়বেন। তার নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। তারপর ইমাম মাহদীর তিরোধান ঘটবে। ঈসা (আ:) তার জানাযার নামাজ পড়াবেন। তাকে বাইতুল মুকাদ্দাসে সমাধিস্থ করা হবে। (শরহে আকীদায়ে সিফারিনিয়্যাহ-২/৮৫) ঈসা (আ:) তার পর পাঁচ বা সাত বা নয় বছর জীবিত থাকবেন। (আল ইয়াওয়াকিতু ওয়াল জাওয়াহিরু-২/১৪৩)
লেখকঃ মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ তাহির মাসউদ।
কার্টেসী: #দৈনিক_ইনকিলাব

0 Comments:

Post a Comment