Sunday, January 26, 2020

// // 1 comment

অভিমানী তোতা


 এক আতর বিক্রেতার একটি তোতা পাখি ছিল। পাখিটি সুমধুর সুরে আওয়াজ দিতে পারিত। আতর বিক্রেতা তোতাকে দেখাশোনার জন্য রাখিত। ঐ তোতা মানুষের ন্যায় খরিদ্দারদের সাথে কথা-বার্তা বলিতে জানিত।

পাখিটি কথা বলার দিক দিয়া মানুষের ন্যায় ছিল। এবং সুমধুর গান করিতে সক্ষম সুচতুর ছিল। 
একদিন মালিক তোতাকে দোকান দেখাশোনা করার জন্য রাখিয়া বাড়ি চলিয়া গেল। হঠাৎ একটা বিড়াল একটা ইঁদুর শিকার করার জন্য লাফ দিয়া পড়িল। তোতা দোকানের মাঝখানে গদীতে বসা ছিল। বিড়ালের ভয়েতে নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য লাফ দিয়া এক পার্শ্বে যাইয়া বসিল। সেখানে আতরের শিশিগুলো রাখা ছিল। তোতার পাখা ও পায়ে লাগিয়া সমস্ত শিশি পড়িয়া গেল। 
বাড়ি হইতে যখন মালিক আসিল এবং নিশ্চিন্তে দোকানে পৌঁছিল- তখন দেখিতে পাইল যে, সমস্ত দোকান এবং যে সমস্ত ফরাশ কাপড় বিছানো ছিল- সবই আতরে সিক্ত হইয়া গিয়াছে। মালিক নমুনা দেখিয়া বুঝিল যে, এই সব কান্ড ঐ তোতার কারণেই হইয়াছে। রাগান্বিত হইয়া তোতাকে এই পরিমাণ মারিল যে, তোতার ‘পালক’ সবই উড়িয়া গেল। অবশেষে টাক-পড়া হইয়া গেল। 
এরপর, কয়েকদিন পর্যন্ত তোতা রাগ হইয়া কথা বলা ত্যাগ করিয়া দিয়াছে। ইহাতে আতর বিক্রেতা অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জ্বিত হইল এবং শুধু নিজের দাড়ি ও চুল অঙ্গুলি দিয়া মোচরাইতেছিল আর আফসোস করিতেছিল, আহা! আমার দোকানের রৌনাক চলিয়া যাইতেছে। যেমন, বাদলা দিনে সূর্যের কিরণ ঢাকিয়া যায়, জমিনের চাকচিক্য কমিয়া যায়, সেই রকম আমার দোকানের রৌশনি চলিয়া যাইতেছে। আমি যখন ইহাকে মারিতেছিলাম, তখন আমার হাত ভাঙ্গিয়া গেল না কেন! 
সে গরীব- মিসকীনকে দান-খয়রাত করিতে আরম্ভ করিল; যাহাতে তোতা পুনঃ কথা বলিতে আরম্ভ করে। 
এইভাবে তিন দিন তিন রাত্রি অতিবাহিত হইবার পর আতর বিক্রেতা অত্যন্ত চিন্তিত ও দুঃখিত অবস্থায় নিরাশ হইয়া দোকানে বসিয়া ভাবিতেছিল যে, দেখি, তোতা কোন্‌ সময় কথা বলে! নানা প্রকারের আশ্চর্যজনক বস্তু তাহাকে দেখাইতেছিল এবং অবাক হইয়া দাঁতে অঙ্গুলি কাটিতেছিল। তোতার সাথে নানা প্রকারের রং-ঢং এর কথাবার্তা বলিতেছিল, যাহাতে তোতা কথা বলিয়া উঠে। উহার কথা বলার আশায় সম্মুখে রং-বেরংয়ের ছবি নিয়া দেখাইতেছিল। কিন্তু কোন কিছুতেই ফল হইতেছিল না। 
তিন দিন পরে আতর বিক্রেতা নিরাশ অবস্থায় দোকানে বসিয়াছিল। এমন সময় ছেঁড়া কম্বল পরিধানকারী মাথায় টাক পড়া এক দরবেশ ওই দোকানের সম্মুখে দিয়া যাইতেছিল। তাহার মাথা শকুনের মাথার ন্যায় পরিষ্কার ছিল। তোতা তাহাকে দেখিবামাত্র বলিয়া উঠিল, “ওহে দরবেশ! তোমার মাথায় টাক! কীভাবে তোমার মাথায় টাক পড়িয়াছে? মনে হয় তুমি কাহারো আতরের শিশি ঢালিয়া ফেলিয়াছ!” 
লোকে তোতার এই কথা শুনিয়া হাসিয়া উঠিল এবং বলিল, দেখো, এই তোতা দরবেশকেও নিজের মত মনে করিয়াছে যে, 'এই ব্যক্তিও আমার ন্যায় আতর ফেলিয়া দিয়াছে। তাহাতে মার খাইয়া মাথার চুল উঠিয়া গিয়াছে। '
তাই,সবসময় অন্য লোককে নিজের মত মনে করা ভুলের শামিল। প্রায়ই বিভিন্ন লোককে একই রকম দেখা যায়; কিন্তু আমলের দিক দিয়া বিস্তৃত পার্থক্য থাকে। 
মৌমাছি ও বল্লা- দুইটি পোকা একই ফুল হইতে মধু পান করে; কিন্তু একটি শুধু দংশন করিতে জানে, অন্যটি মধু দান করে। দ্বিতীয় উদাহরণ, দুই প্রকার হরিণ প্রত্যেকেই জঙ্গলের ঘাস খায় ও পানি পান করে। এক প্রকার মেশক আম্বরবিহীন; অন্য প্রকার হইতে অতি মূল্যবান মেশক আম্বর সুগন্ধি (কস্তুরি) পাওয়া যায়। তৃতীয় উদাহরণ, একই স্থানের মাটির রস গ্রহণ করিয়া দুই প্রকারের গাছে ভিন্ন ফল প্রদান করে; যেমন, নারকেল গাছে নারিকেল দেয় এবং খেজুর গাছে খেজুর ও সুমিষ্ট রস দান করে। এই রকম শত সহস্র উদাহরণ দেখা যায়।
অতএব, ইহা পরিষ্কার যে, দুইটি বস্তু বা প্রাণী; অথবা দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কোনো কোনো দিক দিয়া এক হইলেও অন্যদিক দিয়া সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকে। 
[ঈষৎ সম্পাদিত]
- মসনবী শরীফ। 
[লেখকঃ মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী (রহঃ)]
***

Image by Shirley Hirst from Pixabay

1 comment: