Sunday, January 26, 2020

// // Leave a Comment

হযরত হুসায়েন মানসূর হাল্লাজ (রহঃ)

 হযরত হুসায়েন মানসূর হাল্লাজ (রহঃ) তরঙ্গবিশিষ্ট প্রেম নদীর দুঃসাহসী ডুবুরী ও সত্যের অরণ্যে সিংহস্বরূপ ছিলেন। আল্লাহ্‌ পাকের রাস্তায় নানা ক্লেশ ও যন্ত্রণা ভোগ করিয়া তিনি নিহত হন। তাঁহার জীবনে নানা অদ্ভূত ও অত্যাশ্চর্য ঘটনাবলী ঘটিয়াছে।

তিনি যথেষ্ট এবাদত ও কঠোর পরিশ্রম করিয়াছিলেন। তিনি উঁচুদরের সাহসী ছিলেন। তাঁহার ভাব গূঢ় মধুর এবং তিনি মা’রেফাতে গভীর জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার লেখা বহু কিতাবও ছিল- যাহাতে তাঁহার অগাধ জ্ঞানের পরিচয় মিলে; কিন্তু, তাহা বড় কঠিন ভাষায় লেখা ছিল। ওয়াযে তিনি অদ্বিতীয় বাগ্মী ছিলেন। তাঁহার সারা জীবন দুঃখ ও বিপদে কাটিয়াছে।
বহু দরবেশ তাঁহার কাজ-কারবারে আপত্তি করিতেন। তাঁহারা এমনও বলিয়াছেন, “তাছাউওফে মানসূরের কোনরূপ দখল নাই। ” কিন্তু, মহর্ষি আবদুল্লাহ্‌ খফীফ, শিবলী, আবুল কাসেম নসরাবাদী ইবনে আতা’ (রহঃ) প্রমুখ মানসূরকে সূফী বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।
শেখ আবু সাঈদ ও আবুল কাসেম (রহঃ) প্রমুখ দরবেশ তাঁহার সম্বন্ধে কোনরূপ মন্তব্য না করাই ভালো মনে করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন, “তাঁহার সমস্ত ব্যাপার গোপন ও রহস্যজনক ছিল। কেহ কেহ বলেন, যদি তিনি মকবুল বান্দাই হন, তবে মানুষের কথায় কিছু আসে যায় না; আল্লাহর নিকট তিনি বঞ্চিত হইবেন না। আবার, কেহ কেহ তাঁহাকে যাদুকর, কেহ বা কাফেরও বলিয়াছে এবং তাঁহার গূঢ় উক্তির মর্ম বুঝিয়া না পারিয়া তাঁহাকে নানা প্রকারে যুলুম করিয়াছে; এমনকি অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করিতেও ছাড়ে নাই। বস্তুতঃ, তাঁহার গূঢ় তত্ত্ব সর্বসাধারণের বুঝা মুশকিল। বাগদাদ নগরে এক তরীকার লোক নিজদিগকে ‘হাল্লাজী’ বলিয়া যাহির করিত এবং তাঁহার কথার মর্ম না বুঝিয়াই মিছামিছি নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকিত।
তিনি “আনাল হক্ব” অর্থাৎ, আমি খোদা- এই কথা বলিয়াছেন এবং ইহাই তাঁহার উপর যুলুমের প্রধান কারণ। ফরীদুদ্দীন আত্তার (রহঃ) বলেন, “আমি ইহাই আশ্চর্য বলিয়া মনে করি যে, হযরত মূসা (আঃ) যখন তূর পর্বতে আল্লাহ্‌ পাকের নূর দর্শন করিয়াছিলেন, তখন গাছ হইতে “ইন্নানী আনাল্লাহ্‌” – এই আওয়ায শুনা গিয়াছিল। বলা হয়, ইহা আল্লাহরই আওয়ায- গাছ কিছুই নহে। তবে ইহা কেন অসম্ভব হইবে যে, হুসায়েন মানসূরের যবান হইতে “আনাল হক্ব” আওয়ায উঠিয়াছে, কিন্তু, সেই আওয়ায প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই, হুসায়েন কিছুই নহেন। দ্বিতীয়তঃ যেমন পবিত্র হাদীস শরীফে বলা হয়, “হক্ব তা’আলা হযরত ওমর (রাঃ) এর যবানে অমুক কথা বলিয়াছেন। ” এইরূপে মানসূরে বেলায়ও যদি বলা হয়, তাঁহার যবানে খোদাতাআলাই “আনাল হক্ব” উক্তি করিয়াছেন, তবে আপত্তি কী? এ স্থলে মানসূরের স্বয়ং খোদাতাআলা হওয়ার অর্থ কখনও হয় না। ”
বাগদাদ নগরে হুসায়েন মানসূর নামক এক যাদুকর ছিল। কেহ কেহ, ভুলবশতঃ দুইজনকে এক ব্যক্তি বলিয়া মনে করিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে- সেই যাদুকর ওয়াসেত নগরে পয়দা হয়; আর, মানসূর হাল্লাজ বাগদাদ নগরে পালিত হন। হযরত আবদুল্লাহ্‌ খফীফ বলিয়াছেন, “হুসায়েন মানসূর আল্লাহর মা’রেফাতে জ্ঞানী ছিলেন। ” হযরত শিবলী বলেন, “হাল্লাজ এবং আমি একই পথের মানুষ, তবে পার্থক্য এতটুকু যে, আমাকে প্রভু পাগল বানাইয়া মুক্তি দিয়াছেন; মানসূরকে দিয়াছেন বিবেক। ”
তিনি আজীবন এবাদত ও যিকিরে মশগুল ছিলেন। তিনি তৌহীদ ও মা’রেফাতের চরমে পৌঁছিয়াছিলেন। এক “আনাল হক্ব” ছাড়া তাঁহার সব কাজ শরীয়ত মোতাবেক ছিল। ”
শেষ জীবনে তাঁহাকে শূলে চড়ানোর মাধ্যমে শহীদ করা হয়েছিল। হযরত শিবলী (রহঃ) বলিয়াছেন, “যখন মানসূরকে শূলে চড়ানো হইল, তখন দুষ্ট ইবলীস তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিল, “তুমি যেরূপ কথা বলিতেছ, আমিও সেইরূপই বলিয়াছিলাম। তুমি “আনাল হক্ব” বলিতেছ, আমি “আনা খাইরুন” অর্থাৎ, ‘আমিই সবচেয়ে উত্তম’ বলিয়াছিলাম। তবে, তোমার প্রতি কেন রহমত এবং আমার প্রতি কেন লানৎ হইল?” মানসূর উত্তর করিলেন, “তুমি ‘আনা খাইরুন’ নিজের অহংকারবশত নিজের ইচ্ছায় বলিয়াছিলে; পক্ষান্তরে, আমি আমার ‘আমিত্ব’ সম্পূর্ণ দূর করিয়া “আনাল হক্ব” বলিয়াছি। তোমার প্রতি লানৎ এবং আমার প্রতি রহমতের ইহাই একমাত্র কারণ। জানিও, ‘আমিত্ব’ বা অহংকারভাব কখনও ভাল নয় এবং নিজের ‘আমিত্ব’কে দূরীভূত করাই সর্বোত্তম। ”
- তাযকেরাতুল আওলিয়া। (দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৪-২৩৫)
***

0 Comments:

Post a Comment