Friday, May 3, 2019

// //

মজযূবের বহুরূপ

 যে সকল বুযুর্গ সৃষ্টি সম্পর্কিত খেদমতে নিয়োজিত আছেন তারা রয়েছেন গোপনভাবে। তাঁদের শান হলো হযরত খিজির (আঃ) –এর মতো। তাদের খোঁজ পাওয়া বড় মুশকিল। তারা গোয়েন্দার মতো গোপনে থাকেন। এই জন্যে তাদেরকে তালাশ করা বৃথা। 



অপরদিকে, তাঁরা সৃষ্টি সম্পর্কিত কাজের জন্যে নির্দেশ প্রাপ্ত এবং সে কাজে তাঁরা বাধ্য। তাঁরা যা কিছু করেন, শুধুমাত্র আল্লাহ্‌ পাকের হুকুমে করে থাকেন।
*ফেরীওয়ালা রূপে মজযূবঃএকবার হযরত শাহ্‌ আবদুল আযীয (রহঃ) –এর যামানায় এক ব্যক্তি তাঁর কাছে গিয়ে অভিযোগ করলো যে, “হযরত! আজকাল দিল্লীর শাসন ব্যবস্থায় বড়ই মন্থরতা ছেয়ে পড়েছে। সব কাজের মধ্যেই যেন কুয়াশা বিরাজ করছে। চারিদিকে যেন স্থবিরতা, কোথাও চঞ্চলতা নাই। ”তিনি বললেন, “জনাব, আজকাল এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত খাদেম বড় ঢিলা আছেন। কাজে দ্রুততা এবং চঞ্চলতার জন্যে দরকার কঠিন ব্যবস্থাপনার। ”লোকটি বললেন, “বর্তমানে কে সেই খাদেম, যিনি এই কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন?”তিনি বললেন, “বাজারের অমুক দিকে যে ফেরীওয়ালা খরবুজা বিক্রি করছেন, তিনিই হলেন সেই খাদেম। ”লোকটি আরজ করলো, “গিয়ে দেখা করে আসি?”তিনি বললেন, “যাও, গিয়ে দেখা করে এসো। ”এই লোক তাঁর কাছে গেলো। গিয়ে সালাম আরজ করলো, তারপর আরজ করলো, “আমার কিছু খরবুজার দরকার। ”বিক্রেতা বললো, “ঠিক আছে, নিয়ে যান। ”সে বললো, “আগে চেখে দেখে নেই, পানসা যেন না হয়। ”বিক্রেতা বললো, “ঠিক আছে, দেখে নিন। ”লোকটি ঝুড়ি থেকে একটা খরবুজা কেটে চেখে দেখে বললো, “পানসা!”তারপর আরেকটা কাটলো এবং বললো, “এটাও পানসা। ” এভাবে বিক্রেতার সমস্ত খরবুজা কেটে চেখে দেখে “পানসা” বলতে বলতে চলে গেল। খরবুজা খরিদ করলো না। বিক্রেতা বললো, “ঠিক আছে। ”লোকটি হযরত শাহ্‌ সাহেবের কাছে এসে সকল কথা বললো। তিনি বললেন, “এই হলো খেদমতের দায়িত্বে নিয়োজিত বুজুর্গ, যিনি অত্যন্ত মন্থর এবং গতিহীন; তাই তাঁর প্রভাব প্রকাশ্য শাসকগোষ্ঠীর উপর পড়েছে। ”*ভিস্তিওয়ালা রূপে মজযূবঃএক মাস যেতে না যেতে হঠাৎ করে সকল কাজে উন্নতি দেখা দিল। জনগণের কাজের মধ্যে চঞ্চলতা এবং দ্রুত গতি ফিরে এলো। লোকটি আবার হযরত শাহ্‌ আবদুল আযীয (রহঃ) এর কাছে গিয়ে আরজ করলো, “আজকাল দিল্লীর কাজ-কর্মে, ব্যবসা-বাণিজ্যে যেন আলোর ঝলকানি শুরু হয়ে গেছে। জনগণের মধ্যে দ্রুততা এবং কর্মক্ষমতা ফিরে এসেছে। ”তিনি বললেন, “এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত খাদেমও এইরূপ দ্রুত ও কর্মক্ষম। ”লোকটি আরজ করলো, “কে তিনি খাদেম?”তিনি বললেন, “ফতেহ্‌পুর বাজারে এক ভিস্তিওয়ালা একটি ফুটা-পয়সার বিনিময়ে এক কৌটা পানি পান করিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনিই দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই খাদেম। দুইটি টিনের কৌটার ঝংকার দিয়ে গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তিনি। ”লোকটি বললো, “তাহলে গিয়ে দেখা করে আসি?”তিনি বললেন, “যাও, গিয়ে দেখা করে এসো। ”লোকটি ফতেহ্‌পুর বাজারে গিয়ে পৌঁছলো। সেখানে দেখলো এক ব্যক্তি কাঁধে মশক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং কৌটা বাজিয়ে ঝংকার সৃষ্টি করে বলে বেড়াচ্ছে- “এক পয়সায় এক কৌটা পানি। ”লোকটি একটি ফুটা পয়সা দিয়ে এক কৌটা পানি চেয়ে নিলো। এরপর “পানিতে কুটা আছে” বলে পানি ফেলে দিল এবং আবার পানি চাইলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আরও পয়সা আছে?”লোকটি বললো, “আমার কাছে আর পয়সা নাই। ”এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাকে এক থাপ্পর মেরে দিলেন এবং বললেন, “পয়সা যখন ছিল না তখন কেন আরেক কৌটা চাইলি? খরবুজাওয়ালা ভেবেছো বুঝি?”এই কথা শুনে লোকটি দৌড়ে পালালো। হযরত শাহ্‌ সাহেবের কাছে এসে ঘটনা ব্যক্ত করলো যে, “হযরত! তিনি তো খুবই ক্ষীপ্র!”হযরত বললেন, “এইবার তুমিই দেখে নাও!”*মুচিরূপে মজযূবঃউপরের ঘটনার মতো আরেকটি ঘটনা আছে। এক ব্যক্তি হযরত মাওলানা শাহ্‌ আবদুল আযীয (রহঃ) এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলো, “হযরত! আমি এই সৃষ্টির পরিবর্তনের খেদমতে নিয়োজিত বুজুর্গকে দেখতে চাই। ”তিনি বললেন, “বেশ! একটা চিনা মাটির ঠিকরা নিয়ে এসো। ”লোকটি একটা ঠিকরা নিয়ে আসলো। হযরত শাহ্‌ সাহেব (রহঃ) তাতে কয়েকটি রেখা এঁকে দিয়ে বললেন, “অমুক জায়গায় সরকারী সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আছে। সেখান থেকে কিছু দূরে এক ব্যক্তি বসে জুতা সেলাই করছে দেখতে পাবে। তাকে গিয়ে এই ঠিকরাটা দিবে। ”লোকটি ঠিকরা নিয়ে সেই জায়গায় গিয়ে পৌঁছলো। দেখলো- এক ব্যক্তি বসে জুতা সেলাই করছে; জাহেরী চেহারাও মুচির মতো বানিয়ে রেখেছিলেন। লোকটি তাঁকে ঠিকরাটা দিলো। ঠিকরাটি দেখেই তিনি জুতা সেলাইয়ের যত সাজ-সরঞ্জাম ছড়িয়ে পড়ে ছিল- সেগুলো এক জায়গায় জমা করলেন। ওদিকে সেনা অফিসার বিউগল বাজালেন যে, এখান থেকে যেতে হবে- সব সাজ-সরঞ্জাম একত্র করে নাও।তারপর বুজুর্গ সেই জমা করা সেলাই সরঞ্জামকে তাঁর থলির ভেতর ভরলেন। তখন সেনা অফিসার দ্বিতীয় বিউগল বাজিয়ে বললেন, “সকল তাবু খুলে ফেলো এবং খুঁটি তুলে ফেলো। ”সেনাবাহিনী নির্দেশ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে খুঁটিসহ তাবু গুটিয়ে ফেললো। এইবার তিনি সেলাই সরঞ্জামের থলিটি গলায় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বিউগল বাজলো যে, সবাই রওয়ানা হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও। সৈনিকগণ তাই করলো।এরপর তিনি কী মনে করে থলিসহ বসে পড়লেন। তখন বিউগল বাজলো যে, সবাই নিজ নিজ সরঞ্জাম নামিয়ে রাখো। সৈনিকগণ নির্দেশমত তাই করলো।তারপর তিনি তার থলি খুলে সব সেলাইয়ের সরঞ্জাম বাহির করে রাখলেন। তখন সেনা অফিসার বিউগল বাজিয়ে নির্দেশ দিলেন- সমস্ত তাবু স্থাপন করতে! সৈনিকরা তাই করলো।এরপর তিনি সেলাইয়ের সরঞ্জামগুলি ছড়িয়ে রাখলেন। তখন বিউগল বাজিয়ে নির্দেশ হলো- সকল সরঞ্জাম যথাস্থানে স্থাপন করতে; সৈনিকরা তাই করলো!সেই মুচি বুজুর্গ আবার কী মনে করে তার সামানগুলি গুছিয়ে থলিতে ভরে উঠে দাঁড়ালেন। সেনা অফিসার নির্দেশ দিলেন- তাবু গুছিয়ে রওয়ানা হওয়ার জন্যে তৈরি হও। সৈনিকগণ তাই করলো।বুজুর্গ আবার বসে পড়লেন। থলির জিনিসপত্র যথাস্থানে ছড়িয়ে রাখলেন। তখন বিউগল হলো- “সৈনিকরা তাবু স্থাপন করো!-”এইভাবে কয়েকবার হলো। সৈনিকরা তখন পরস্পর বলতে লাগলো যে, সেনা অফিসারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে- তার চিকিৎসা করা দরকার! [কিন্তু, তারা বুঝতে পারলো না- আড়ালে পরিচালনা শক্তি কোথা থেকে আসছে এবং কার নির্দেশ পালিত হচ্ছে। ]সেই লোকটি এই সব ঘটনা দেখে সেখান থেকে দ্রুত হযরত শাহ্‌ সাহেব (রহঃ) -এর কাছে এসে সকল বৃত্তান্ত বর্ণনা করলো। তিনি বললেন, “আহলে খেদমত এই রকমই হয়ে থাকেন। ”শায়খ আকবর (রহঃ) বলেন, “প্রত্যেক গ্রামে (মহল্লায়) একজন কুতুব থাকেন। কিন্তু, এরা অধিকাংশই মজযূব হয়ে থাকেন। আর, অধিকাংশ মজযূব বুজুর্গগণের হাতেই সৃষ্টির পরিবর্তনের কাজ নিয়োজিত থাকে। কখনও কখনও সালেক বুজুর্গগণও এরূপ দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। -আল ইফাযাতুল ইয়াওমিয়্যাহ্‌। [খন্ড ৭, পৃষ্ঠা ২০-২২]