Friday, August 2, 2019

// // 1 comment

সত্যপথ প্রাপ্তি

 হযরত ইবরাহীম আদ্‌হাম (রহঃ) ছিলেন বলখের প্রতাপশালী বাদশাহ্‌। এক বিশাল রাজ্য ছিল তাঁহার শাসনাধীন। তিনি যখন ভ্রমণে বাহির হইতেন, তখন ৪০ জন করিয়া স্বর্ণের ঢাল ও রৌপ্যের গুর্জধারী সৈন্য তাঁহার অগ্রে ও পশ্চাতে তাঁহার দেহরক্ষীরূপে মোতায়েন থাকিত। 
একদা শাহী মহলে গভীর রাত্রে
তিনি সুকোমল শয্যাযুক্ত পালঙ্কে শায়িত ছিলেন; এমন সময় ছাদের উপর লোক চলার শব্দ টের পাইলেন। তিনি উচ্চ শব্দে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছাদের উপর কে?” উত্তর আসিল, “তোমারই একজন বন্ধু। আমার একটি উট হারাইয়াছে; উহা তালাশ করিতেছি। ” তিনি বলিলেন, “তুমি তো দেখিতেছি বেশ বোকা! রাজপ্রাসাদের ছাদের উপর উট আসিবে কেমন করিয়া?” ছাদের উপরের লোকটি বলিলেন, “হে গাফেল! তুমি মখমলের পোশাক পরিয়া স্বর্ণের সিংহাসনে বসিয়া আল্লাহ্‌ তা’আলাকে অন্বেষণ করিতেছ; ইহা ছাদের উপর উট অন্বেষণ করার করার চেয়ে অধিক আশ্চর্যের বিষয় নহে কি?” একথা বলিয়াই ছাদের উপরের লোকটি অদৃশ্য হইয়া গেলেন। তাঁহার এই কথায় ইবরাহীম আদ্‌হামের অন্তরে একপ্রকার ভীতির সঞ্চার হইল এবং তাঁহার হৃদয়ে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। তিনি খুব চিন্তিত, পেরেশান এবং ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন।
পরদিন যখন তিনি রাজদরবারে সিংহাসনে সমাসীন, মন্ত্রীমন্ডলী ও ওমারাগণ প্রত্যেকের নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট এবং চাকর-নকরেরা সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান; অর্থাৎ, সাধারণ রাজদরবার চলিতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ একজন তেজস্বী পুরুষ খুব শান-শওকতের সহিত দরবারে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার গাম্ভীর্য দর্শনে প্রভাবান্বিত হইয়া দ্বাররক্ষী ও চাকর-নকরেরা তাঁহাকে বাধা দিবার সাহস পাইল না। এমনকি, একথাও জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিল না যে, “আপনি কে?” সকলে নির্বাক ও হতভম্ব হইয়া রহিল। আগন্তুক লোকটি সিংহাসনের নিকটবর্তী হইলে ইবরাহীম আদ্‌হাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কী চাও?” লোকটি উত্তর করিলেন, “ভয় করিবেন না, আমি এই পান্থশালায় অবস্থান করিতে চাই না। ” বাদশাহ্‌ বলিলেন, “ইহা পান্থশালা নহে, ইহা আমার রাজমহল। ” আগন্তুক বলিলেন, “আচ্ছা, বলুন তো আপনার পূর্বে এই মহলে কে বাস করিত?” বাদশাহ্‌ বলিলেন, “আমার পিতা। ” আগন্তুক আবার প্রশ্ন করিলেন, “আপনার পিতার পূর্বে এই রাজপ্রাসাদ কাহার অধিকারে ছিল?” বাদশাহ্‌ বলিলেন, “আমার পিতামহের। ” এইরূপে আগন্তুক আরও কয়েকবার জিজ্ঞাসা করিল এবং বাদশাহ্‌ “অমুক অমুক” বলিয়া উত্তর দিলেন। তখন আগন্তুক বলিলেন, “আচ্ছা, এখন আপনিই বলুন, যেখানে একজন আসিতেছে আর একজন যাইতেছে; ইহা পান্থশালা ছাড়া আর কী হইতে পারে?” একথা বলিয়াই তিনি বাহির হইয়া পড়িলেন। হযরত ইবরাহীম আদ্‌হাম একাকী তাঁহার পিছে পিছে দৌঁড়াইতে লাগিলেন এবং কিছুদূর গিয়া তাঁহাকে পাইলেন। বাদশাহ্‌ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে?” তিনি বলিলেন, “আমি খিযির। ” একথা শুনিয়াই ইবরাহীমের মনে উৎসাহ্‌-উদ্দীপনা বাড়িয়া গেল। তিনি আদেশ করিলেন, “ঘোড়া প্রস্তুত করো, আমি জঙ্গলে ভ্রমণ করিব। দেখি, আরও কী প্রকাশ পায়। ” অতঃপর, তিনি লোক-লস্কর লইয়া জঙ্গলের দিকে যাত্রা করিলেন এবং লক্ষ্যহীনভাবে যে দিকে ইচ্ছা সে দিকেই চলিতে লাগিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হইয়া তিনি সঙ্গীয় লোকজন হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িলেন। অকস্মাৎ গায়েব হইতে আওয়ায আসিল, “এখনও জাগ্রত হও, এমন কী মৃত্যু তোমাকে জাগ্রত করার পূর্বে জাগ্রত হও। ” শব্দগুলি তিন চারিবার শুনিতে পাইলেন। হযরত ইবরাহীম আদ্‌হাম ইহা শুনিয়া আত্মহারা হইয়া পড়িলেন। ইতিমধ্যে দেখিতে পাইলেন, একটি হরিণ সম্মুখে দন্ডায়মান, তৎক্ষনাৎ তিনি উহাকে শিকার করিতে উদ্যত হইলেন। হরিণটি বলিয়া উঠিল, “তুমি আমাকে শিকার করিতে পারিবে না। আমিই তোমাকে শিকার করিবার জন্য প্রেরিত হইয়াছি। হে ইবরাহীম! একাজের জন্য কি তোমাকে সৃষ্টি করা হইয়াছে? তোমার কি আর কোন কর্তব্য নাই?” হযরত ইবরাহীম আদ্‌হাম পুনঃ পুনঃ সাবধান বাণী শুনিয়া ব্যাপার কিছুটা বুঝিতে পারিলেন। হরিণের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া নিজের ঘোড়ার প্রতি দৃষ্টি করিলেন। ঘোড়ার জীন হইতেও হরিণের কথাগুলির প্রতিধ্বনি শুনিতে পাইলেন। তখন তাহার হৃদয়ে একপ্রকার ভয়ের সঞ্চার হইল এবং অন্তরচক্ষু খুব পরিষ্কার হইয়া গেল। তাঁহাকে সংসারের মায়াজাল হইতে মুক্ত করিয়া নিজের দিকে আকর্ষণ করাই যখন আল্লাহ্‌ পাকের ইচ্ছা হইয়াছে, তখন নিজের লেবাসের প্রতি দৃষ্টি করা মাত্র তিনি কোর্তার বোতাম হইতেও হরিণের কথাগুলি অবিকল প্রতিধ্বনি শুনিতে পাইলেন। এখানে আসিয়া তাঁহার অন্তর্দৃষ্টি উন্মুক্ত হইয়া গেল। ফলে ফেরেশতাজগতের দ্বার তাঁহার সম্মুখে মুক্ত হইয়া পড়িল। সেই জগতের ব্যাপারসমূহ তাঁহার হৃদয়ে অবতীর্ণ হইতে লাগিল এবং ইয়াকীনের স্তরে যাইয়া পৌঁছিলেন। তখন তিনি ভাবাবেগে কান্নায় ফাটিয়া পড়িলেন। অশ্রুর বন্যা প্রবাহিত হইল। চোখের প[নিতে পরিহিত বস্ত্র; এমনকি ঘোড়া পর্যন্ত ভিজিয়া গেল। তিনি খাঁটি মনে তওবা করিলেন। সংসারের প্রতি তাঁহার বিতৃষ্ণা ও বীতশ্রদ্ধা জাগিয়া উঠিল। তিনি সদর রাস্তা ত্যাগ করিয়া পার্শ্ববর্তী গভীর জঙ্গলের দিকে চলিতে লাগিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হইতেই চটের খসখসে লেবাস পরা এক রাখালের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। শাহী লেবাস তাঁহাকে দিয়া তিনি তাঁহার লেবাস পরিধান করিলেন। বাদশাহ্‌ ইবরাহীম আদ্‌হাম বাদশাহীর বিনিময়ে ফকিরী গ্রহণ পূর্বক খালি পায়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরিতে লাগিলেন। তখন হইতে নিজের গতকালের গুনাহ্‌ স্মরণ করিয়া তওবা করিতে লাগিলেন এবং আল্লাহ্‌ তা’আলার দরবারে রোদন করিতে লাগিলেন। এইরূপে ঘুরিতে ঘুরিতে ‘মারভ্‌’ নগরে পৌঁছিলেন। 
মারভের এক পুলের উপর দিয়া কোন একজন অন্ধ লোককে যাইতে দেখিয়া তিনি আশঙ্কা করিলেন- লোকটি হয়তো পুল হইতে পড়িয়া যাইবে। তিনি আল্লাহ্‌ পাকের দরবারে দোয়া করিলেন, "اللهم أحفظه"; অর্থাৎ, “ইয়া আল্লাহ্‌, ইহাকে রক্ষা করুন। ” তৎক্ষণাৎ সেই অন্ধ লোকটি শূন্যে উঠিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইল এবং ইবরাহীম আদ্‌হামকে নিজের দিকে আকর্ষণ করিয়া লইল। এই ব্যাপার দেখিয়া তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া পড়িলেন। ভাবিতে লাগিলেন, ‘সোবহানাল্লাহ্‌! ইনি কত বড় বুযুর্গ লোক!’ অতঃপর তিনি তথা হইতে যাত্রা করিয়া নিশাপুরে পৌঁছিলেন। সেখানে একটি প্রসিদ্ধ গুহা ছিল।নয় বৎসর পর্যন্ত তিনি উক্ত গুহার মধ্যে অবস্থান করিলেন এবং ‘মুজাহাদাহ্‌’ ও সাধনায় প্রবৃত্ত থাকিয়া আখেরাতের প্রচুর সম্বল সংগ্রহ করিলেন। উক্ত গুহায় তিনি একাকী বাস করিতেন; বৃহস্পতিবার দিন গুহা হইতে বাহির হইয়া জঙ্গল হইতে লাকড়ী সংগ্রহ করিয়া আনিতেন এবং শুক্রবার দিন সকালবেলা উহা বাজারে নিয়া বিক্রয় করিতেন। অতঃপর জুমু’আর নামায আদায় করিয়া রুটি খরিদ করিতেন এবং উহার অর্ধাংশ ফকিরকে দান করিয়া বাকী অর্ধাংশ লইয়া গুহায় ফিরিয়া যাইতেন; আর, উহা দ্বারা পরবর্তী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গুহায় অবস্থান করিতেন ও এবাদতে মশগুল থাকিতেন। 
• তাযকেরাতুল আওলিয়া। [১ম খন্ড, ৯৯-১০১ পৃষ্ঠা]

1 comment: