Wednesday, May 30, 2018

// // Leave a Comment

মুক্তিপত্র

 শামা’উন নামীয় জনৈক অগ্নিপূজক হযরত হাসান বছরী (রহঃ) –এর প্রতিবেশী ছিল। একবার যখন সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়া মরণাপন্ন অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিল, তখন এক ব্যক্তি আসিয়া হাসান বছরী (রহঃ) –কে সংবাদ দিল। সংবাদ পাওয়া মাত্র তৎক্ষণাৎ তিনি লোকটির নিকট ছুটিয়া গেলেন। দেখিলেন- আগুনের ধোঁয়ার ন্যায় তাহার সর্বশরীর কাল হইয়া গিয়াছে।
হযরত হাসান বলিলেন, “ভাই! সারা জীবন আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে কাটাইয়াছ; অন্ততঃ এখন এই অবস্থায় খোদাকে ভয় কর এবং ইসলাম গ্রহণ কর। আল্লাহ তা’আলার অফুরন্ত রহমত তোমার উপর বর্ষিত হইবে। ”
শামা’উন ঘৃণার সহিত বলিল, “দুইটি কারণে আমি ইসলাম ধর্মকে পছন্দ করি না। প্রথমতঃ, তোমরা দিবা-রাত্রি দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাক। দ্বিতীয়তঃ, তোমরা মুখে বল, মৃত্যু অনিবার্য, অথচ অহরহই খোদা তা’আলার অসন্তুষ্টির কার্য করিয়া থাক। ”
তিনি বলিলেন, “ভাই! তুমি বন্ধুর মতই কথা বলিয়াছ। কোন কোন মুসলমান সেইরূপ করিতেছে সত্য, কিন্তু তুমি কী করিতেছ? সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলাকে ভুলিয়া তাঁহার সৃষ্টবস্তু অগ্নি- যাহার উপাসনায় রত থাকিয়া তুমি তোমার স্বীয় অমূল্য জীবন নষ্ট করিতেছ? কেন তুমি একশত বছর যাবৎ অগ্নিকে নিজের মা’বূদ জ্ঞানে পূজা করিতেছ? আমি কখনও অগ্নি পূজা করি নাই। অথচ আমার খোদা ইচ্ছা করিলে অগ্নির দাহিকা শক্তি এমনভাবে লোপ করিয়া দিতে পারেন যে, ইহা আমার একটি লোমও স্পর্শ করিতে পারিবে না। আস, উভয়ই আমরা আপন আপন হাত অগ্নির মধ্যে ঢুকাইয়া দিয়া পরীক্ষা করি, যদি আমার হাত দগ্ধ না হয়, তবে তোমার মিথ্যা উপাস্য অগ্নির দুর্বলতা ও অসারতা এবং আমার প্রকৃত মা’বূদ আল্লাহ্‌ তা’আলার শক্তি প্রমাণিত হইবে। একথা বলিয়াই তিনি নিজের হাত কিছুক্ষণ পর্যন্ত আগুনে ধরিয়া রাখিলেন। অপার করুণাময় আল্লাহ্‌ পাকের ইচ্ছায় তাঁহার হাতের একটি লোমও দগ্ধ হইল না, তাঁহার চোখে-মুখে জ্বালা যন্ত্রণার সামান্য চিহ্ন মাত্রও প্রকাশ পাইল না। 
এই দৃশ্য দেখিয়া শামা’উনের মনে অনুতাপ জাগিল এবং অনুতপ্ত হৃদয়ে হযরত হাসান বছরীর নিকট আবেদন করিল, “হে হাসান! জীবনের সত্তরটি বৎসর আমি অগ্নির উপাসনায় নষ্ট করিয়া দিলাম, আর এখন কয়েকটি শ্বাস মাত্র বাকী; এ অবস্থায়ও যদি কোন উপায় থাকিয়া থাকে তাহা হইলে মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া আমাকে তাহা বলিয়া দিন। ” হযরত হাসান বলিলেন, এখন তোমার মুক্তির একটি মাত্র উপায়- ইসলাম গ্রহণ করা। শামা’উন বলিল, যদি আমাকে এ মর্মে একখানা পত্র লিখিয়া দিতে পারেন যে, এই মুহূর্তে আমি ইসলাম গ্রহণ করিলে মৃত্যুর পর আল্লাহ্‌ তা’আলা আমাকে আযাব হইতে মুক্তি দিবেন, তবে আমি এখনই তাঁহার উপর ঈমান আনিব। হযরত হাসান (রহঃ) তৎক্ষনাৎ একখানি মুক্তিপত্র লিখিয়া দিলেন। শামা’উন উহাতে স্থানীয় গণ্যমান্য লোকের স্বাক্ষর লইয়া হযরত হাসানের হাতে ফেরত দিল; এবং হায়! হায়! বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিল এবং বলিল, “আমার মৃত্যুর পর আপনি আমাকে গোসল দিবেন, স্বহস্তে আমাকে কবরে নামাইবেন এবং পত্রখানা আমার হাতে রাখিয়া দিবেন। ক্কিয়ামতের ময়দানে আমার মুক্তির নিদর্শন স্বরূপ এই পত্রখানা আমার হাতে থাকিবে। এই বলিয়া শামা’উন ‘কলেমায়ে শাহাদাৎ’ উচ্চারণ করিতে করিতে নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করিয়া পরপারে চলিয়া গেলেন। হযরত হাসান (রহঃ) শামা’উনের সহিত সবগুলি প্রতিশ্রুতিই পালন করিলেন। পরক্ষণেই ভাবিতে লাগিলেন, আমি নিজেই পাপী আর এ পাপীকে উদ্ধার করা আমার পক্ষে কী করিয়া সম্ভব? নিজের মুক্তিরই নিশ্চয়তা নাই। খোদার অধিকারে কেন হাত দিলাম? এই চিন্তায় রাত্রির অধিকাংশ এবাদতে কাটাইয়া শেষ ভাগে একটু ঘুমাইয়া পড়িতেই তিনি স্বপ্নে দেখিলেন, শামা’উন একটি অতি উজ্জ্বল তাজ মাথায় ও মূল্যবান পোশাকে সুসজ্জিত। হাসি মুখে বেহেশতে বিচরণ করিয়া বেড়াইতেছেন। তিনি শামা’উনকে তাঁহার অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি হাসিমুখে উত্তর করিলেন, বাহ্যিক যেমন দেখিতেছেন আল্লাহ্‌ আমাকে মা’ফ করিয়াছেন, তাঁহার বেহেশতে স্থান দিয়াছেন এবং তাঁহার সাক্ষাৎ দানে আমাকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন। এই পত্রখানা ফিরাইয়া নিন, এখন আর ইহার আবশ্যক নাই। হযরত হাসান (রহঃ) –এর ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল; তিনি জাগিয়া দেখিলেন, পত্রখানা তাঁহার হাতে রহিয়াছে। বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, “খোদা! তোমার কোন কাজই নিয়মের অধীন নয়। সত্তর বৎসর অগ্নি পূজার পরেও এক কলেমার বদৌলতে তুমি শামা’উনকে সাক্ষাৎ পর্যন্ত দান করিয়াছ। সত্তর বৎসর ঈমানের সহিত থাকিয়া মৃত্যুবরণ করিলে তাহাকে যে মা’ফ করিবে ইহাতে আর সন্দেহ কী?”
-তাযকেরাতুল আওলিয়া। [১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩১]
***

0 Comments:

Post a Comment